বাংলাদেশের জ্বালানি খাত দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস নির্ভর। বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্পকারখানা, পরিবহন ও গৃহস্থালি পর্যায়ে গ্যাসের ব্যবহার প্রতিদিনই বাড়ছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে দেশে গ্যাসের সরবরাহ সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে সরকার বাধ্য হচ্ছে বিকল্প উৎস খুঁজতে। বঙ্গোপসাগরে ব্যর্থ অনুসন্ধানের পর এবার অন্তর্বর্তী সরকার স্থলভাগে বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে নতুন গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য ‘প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট’ (পিএসসি) চূড়ান্ত করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের আগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের সরকারের জন্য চাপ তৈরি করবে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের মেয়াদকালে স্থলভাগের কোনো গ্যাস ব্লক বিদেশি কোম্পানির হাতে না দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দেশের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে শক্তিশালী করে স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান চালানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মেয়াদ শেষে সেই সরকার মার্কিন কোম্পানি শেভরনকে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের পাশে নতুন এলাকায় অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অনুমতি দেয়। যদিও এর বাইরে স্থলভাগের জন্য কোনো নতুন পিএসসি অনুমোদন পায়নি। ফলে গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। ভোলায় কিছু সাফল্য এলেও দেশের অন্য অঞ্চলগুলোতে বড় কোনো সাফল্য আসেনি।
অন্তর্বর্তী সরকার এখন নতুনভাবে স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করছে। পেট্রোবাংলার সূত্রে জানা গেছে, সরকারের চাপেই তারা নতুন একটি পিএসসি প্রণয়ন করেছে এবং মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে অনুমোদনের জন্য। নতুন চুক্তিতে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ব্রেন্ট ক্রুড)-এর সঙ্গে সমন্বয় করে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রেন্ট ক্রুডের দাম যদি ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার হয়, তবে গ্যাসের দাম হবে প্রতি হাজার ঘনফুটে ৮.৫ ডলার। বর্তমানে বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬৬ ডলার হলে গ্যাসের দাম দাঁড়ায় প্রায় ৫.৬ ডলার। কিন্তু বর্তমানে পেট্রোবাংলা শেভরনসহ অন্যান্য কোম্পানির কাছ থেকে ২.৫ থেকে ৩ ডলারে গ্যাস কিনে থাকে। ফলে নতুন পিএসসি কার্যকর হলে গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।
এই নতুন ব্যবস্থায় বিদেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে, কূপ খনন করবে এবং গ্যাস উত্তোলন শুরু হলে প্রথমে তারা নিজেদের বিনিয়োগ ফেরত নেবে। এরপর অবশিষ্ট গ্যাস পেট্রোবাংলা ও কোম্পানির মধ্যে নির্ধারিত ভাগে বণ্টন হবে। পেট্রোবাংলা সেই গ্যাস কিনে স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহ করবে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই কাঠামোতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর লাভের পরিমাণ অনেক বেশি থাকবে এবং গ্যাসের দাম জনগণের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) প্রকৌশলী মো. শোয়েব বলেছেন, নতুন পিএসসি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তার দাবি, সাগরের তুলনায় স্থলভাগের গ্যাসের দাম কম নির্ধারণ করা হয়েছে, কারণ এখানে অনুসন্ধানের ঝুঁকি তুলনামূলক কম। সরকারের অনুমোদন মিললেই এ বছরের মধ্যেই দরপত্র আহ্বান করা সম্ভব হবে। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগ অনৈতিক ও অপরিণামদর্শী। নির্বাচনের আগে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ভবিষ্যতের সরকারের জন্য জটিলতা তৈরি করবে। ইতোমধ্যেই তারা সার ও শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে উৎপাদন ব্যয়ে। এখন যদি গ্যাস অনুসন্ধানও বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তবে দেশের জ্বালানি খাত সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমাদের এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে স্থলভাগের গ্যাস বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’ তাঁর মতে, বাপেক্সকে শক্তিশালী করাই এখন সময়ের দাবি। বাপেক্সকে প্রতিযোগিতার সুযোগ দিয়ে সরকারি পর্যায়ে গবেষণা, আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে দেশীয় সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
অর্থনীতিবিদরাও একমত যে, নতুন পিএসসি কার্যকর হলে আমদানি নির্ভরতা কমবে না বরং দেশীয় গ্যাসের মূল্য বাড়বে, যা শিল্পখাতের উৎপাদন ব্যয় ও ভোক্তা পর্যায়ের খরচ উভয়ই বাড়াবে। তাঁরা মনে করেন, সরকারের উচিত স্থলভাগে নতুন অনুসন্ধানের আগে বর্তমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া এবং পুরোনো কূপগুলো পুনরায় সক্রিয় করার প্রকল্প নেওয়া। বর্তমানে দেশে মোট ২২টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন ১৮০০ থেকে ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে সিলেট, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্ষেত্রগুলো থেকে মূল সরবরাহ আসে। ভোলার দুটি ক্ষেত্র এখনো জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারেনি, সেখানকার গ্যাস স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটের পর ভোলা-বরিশাল অঞ্চল নতুন গ্যাস হাব হতে পারে। তবে শরীয়তপুরে বাপেক্সের খনন কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ায় সরকার সেই অঞ্চলেও নিরুৎসাহিত।
এর আগে মার্কিন কোম্পানি শেভরন সুন্দরবনে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিল। কিন্তু একটি কূপ খননের পর তারা জানায়, উত্তোলন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। অন্যদিকে পাহাড়ি এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ইতিহাস শত বছরেরও পুরোনো, কিন্তু কোনো কোম্পানি সাফল্য পায়নি। ১৯১৪ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে প্রথমবার বার্মা ওয়েল কোম্পানি কূপ খনন করেছিল, কিন্তু গ্যাস পাওয়া যায়নি। এরপর আরও ১২টি কূপ খনন হলেও কোনওটিতেই উত্তোলনযোগ্য গ্যাস পাওয়া যায়নি। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে গ্যাস সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। শিল্পখাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি সরবরাহে অনিয়ম দেখা দিচ্ছে, এমনকি গৃহস্থালি পর্যায়ে গ্যাসের চাপও কমে গেছে। সরকারের দাবি, স্থলভাগে নতুন অনুসন্ধান হলে এই সংকট কিছুটা লাঘব হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন—বিদেশি কোম্পানিকে সুযোগ দিয়ে কি এই সমস্যা টেকসইভাবে সমাধান করা সম্ভব?
তাঁরা বলছেন, বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ সাময়িক স্বস্তি দিলেও তা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক নির্ভরতা বাড়ায়। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন বাপেক্স, সেগুলোকে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা দিলে তারা সফলভাবে অনুসন্ধান চালাতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন—ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে সরকার নিজস্ব কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে, যার ফলে তারা বিদেশি নির্ভরতা থেকে অনেকটা মুক্ত হতে পেরেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত তাই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, নির্বাচনের আগে এই উদ্যোগের পেছনে বিদেশি স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, গ্যাস অনুসন্ধান বিলম্ব করলে দেশের জ্বালানি খাত আরও বিপর্যস্ত হবে, তাই সরকারের বিকল্প ছিল না। তবে সাধারণভাবে বিশ্লেষকরা একমত যে, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও জাতীয় স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ তেল-গ্যাস শুধু অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার অংশ। সুতরাং এই খাতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেশের জনগণের মতামত, সংসদের আলোচনা এবং স্বচ্ছ নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া থাকা অপরিহার্য।
সর্বশেষে বলা যায়, স্থলভাগের গ্যাস ব্লক বিদেশিদের ইজারা দেওয়ার তোড়জোড় একদিকে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুললেও, অন্যদিকে জাতীয় স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার ওপর গভীর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রতিটি সিদ্ধান্তেরই বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে—অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক। তাই বিশেষজ্ঞরা আহ্বান জানাচ্ছেন, দ্রুত সিদ্ধান্তের পরিবর্তে যুক্তিনির্ভর, স্বচ্ছ এবং দেশীয় সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি টেকসই জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করা জরুরি।
সকালবেলা/এমএইচ