জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ
মানিকগঞ্জে প্রতি বছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভবন নির্মাণ, বাড়ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জেলার সাতটি উপজেলার প্রায় তিন’শ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের অনেকেই ফায়ার সার্ভিসের সনদ ছাড়াই পরিচালনা করছেন ব্যবসা কার্যক্রম। আবার কারো লাইসেন্স একবার করলেও তা আর নবায়ন করেননি। অর্থাৎ ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন না নিয়েই বে-আইনীভাবে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এতে করে পুরো জেলার গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ম পরিবেশ অগ্নি ঝুঁকিতে পড়েছে।
উন্নয়নকর্মী ও কলেজ শিক্ষক ইয়াসিনুর রহমান বলেন, মানিকগঞ্জ এখন ক্রমেই ‘ফায়ার রেড জোন’ এ রূপ নিচ্ছে। অর্থনীতি ও নাগরিক নিরাপত্তা দুটোই এখন অগ্নি ঝুঁকিতে। লাইসেন্স বিহীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ফলে ফায়ার সেফটি বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে, ছোট্ট একটি অগ্নিকাণ্ডে বড় ধরনের প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হতে পারে । এখনই প্রয়োজন শক্তিশালী তদারকি, সচেতনতা ও শাস্তির সঠিক প্রয়োগ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক ( সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, প্রতিনিয়ত নতুন ভবন হচ্ছে, নতুন দোকান হচ্ছে কিন্তু কেউ ফায়ার সেফটি নিয়ে ভাবেনা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও এ বিষয়ে কোন দৃশ্যমান অভিযান করেনা। আগুন না লাগা পর্যন্ত যেন কারো ঘুম ভাঙবে না পরিস্থিতি এমন হয়ে গেছে।
মানিকগঞ্জ এখন এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরির উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রশাসনের কার্যকর নজরদারি ও জরিমানার বাস্তব প্রয়োগ, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
মানিকগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় জানায়, জেলার একাধিক ভবনে নেই অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র, পানির উৎস কিংবা নির্গমন পথ। এসব কারণে ৩০টি বড় বাণিজ্যিক ভবনকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালে মানিকগঞ্জে ২৩২টি এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আরও ১৪৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে প্রাপ্ত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া চলছে। এখানে ২৩টি স’ মিল, ২৩টি ক্লিনিক ও হাসপাতাল এবং ১৮টি শিল্প কারখানা লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া কার্যক্রম চালাচ্ছে। এছাড়া বেকারি, অয়েল মিল, স্টোর, ব্যাটারি, সিএনজি পাম্পসহ প্রায় ৪০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও ফায়ার লাইসেন্স ছাড়া চলছে।
সিংগাইরে ১৭টি স’ মিল, চারটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ১৬টি শিল্প কারখানা লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া চলছে। এছাড়া দশটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও ফায়ার লাইসেন্স ছাড়া কার্যক্রম চালাচ্ছে।
ঘিওরে মোট ৫৭টি প্রতিষ্ঠান ফায়ার লাইসেন্স ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে স’ মিল ও রাইস মিল ৭টি, স্টোর ১৫টি, হার্ডওয়্যার ৭টি, এন্টারপ্রাইজ ১১টি, ট্রেডার্স ৮টি, টেলিকম ৪টি, গ্যাস স্টেশন ১টি, বেকারি ১টি, ইলেকট্রনিক্স ২টি এবং ফ্যাশন ১টি প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত।
হরিরামপুরে তিনটি স’ মিল, দুটি বেকারি, দুটি ক্লিনিক এবং একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া চলছে। দৌলতপুরে পাঁচটি স’ মিল, একটি বেকারি, দুটি ক্লিনিক এবং ১৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া কার্যক্রম চালাচ্ছে।
শিবালয়ে তিনটি বড় প্রতিষ্ঠান, তিনটি স’ মিল, বারোটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া চলছে। সাটুরিয়ায় ১৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া কার্যক্রম চালাচ্ছে।
জানা গেছে, সাতটি উপজেলায় লাইসেন্স নবায়নবিহীন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৮৫টি ছাড়িয়েছে। এতে হাসপাতাল, ক্লিনিক, স’ মিল, অয়েল মিল, ইটভাটা, বেকারী, ব্যাটারি ব্যবসা, সিএনজি পাম্প, প্লাস্টিক কারখানা, কেমিক্যাল ও গ্যাস সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক ভবন, দোকানপাট, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও গার্মেন্টস কারখানা অন্তর্ভুক্ত। অনেক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ফায়ার অ্যালার্ম, এক্সিট প্ল্যান বা পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে, যা অগ্নি ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করছে।
বাংলাদেশ ফায়ার প্রিভেনশন অ্যান্ড ফায়ার ফাইটিং অ্যাক্ট ২০০৩ অনুযায়ী ফায়ার লাইসেন্স ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা অবৈধ। আইন ভঙ্গ করলে জরিমানা ও ৬ মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। এমনকি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করার বিধানও রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ফায়ার সার্ভিসের সনদ পেতে হলে অনেক নিয়ম কানুন মেনে ভবন নির্মাণ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হয়। যারা আইন মানতে চান না তারাই সনদ নেন না। আবার অনেকক্ষেত্রে ফায়ার সনদ না থাকলে সরকারি অনেক দপ্তরের অনুমোদন আটকে দেওয়া হয়। তখন বাধ্য হয়ে অনেকে ফায়ার সনদ নিয়ে থাকেন। তবে তাদের অন্য দপ্তরের কাজ হাসিল হয়ে গেলে আর ফায়ার সনদ নবায়ন করেন না। আর পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ অনেক সময় সব ঠিক ঠাক না থাকলেও ফায়ার সনদ ইস্যু করেন। ফলে সব মিলিয়ে অগ্নি ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে।
যেসকল প্রতিষ্ঠান ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন করেননি এমন ১৯ টি প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের ভাষ্য, লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়া জটিল ও ব্যয়বহুল হওয়ায় এ সনদ নেওয়ার আগ্রহ কম। একবার সনদ নিলে পুনরায় তা নবায়ন করতে হয় বিষয়টি অনেকে জানেন না। কেউ কেউ ‘লাইসেন্স ছাড়াই চলছে, তাই আমিও নিচ্ছি না’ এই মানসিকতা নিয়ে অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন।
মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ফায়ার লাইসেন্স বা নবায়ন না থাকলে সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। তবে সম্প্রতি জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকলে ফায়ার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, পরিবেশের সুরক্ষা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ফায়ার লাইসেন্সও অপরিহার্য।’
মানিকগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “আমাদের দপ্তরের আবেদন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক। ফলে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র ছাড়া এ দপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা নিয়মিতভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচেতন করার চেষ্টা করি।”
সার্বিক বিষয় নিয়ে মানিকগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ মিয়ার সাথে কথা বলেন এ প্রতিবেদক।
তিনি বলেন, প্রায় তিন’শ প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনাদের এমন গাফিলতির কারণে পুরো জেলা অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন স্কুল,কলেজসহ বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম করছি।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক (যুগ্ম সচিব) ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দপ্তর চাইলে আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় সহযোগিতা করব।’
সকালবেলা/এমএইচ