আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে জাতীয় পার্টি (জাপা)।
শনিবার (১১ অক্টোবর) নির্বাচন অংশগ্রহণ, দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে ষড়যন্ত্র এবং রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণসহ সার্বিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে ঢাকায় জরুরি সভা আহ্বান করেছেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এ সভায় সারা দেশের জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সভা শেষে রাজধানীতে এক বিশাল শোডাউন মিছিল করার পরিকল্পনাও নিয়েছে দলটি, যেখানে নেতৃত্ব দেবেন জাপা চেয়ারম্যান নিজে। রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র, দলটির কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানিয়েছেন, এই সভায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসবে। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন মহল ষড়যন্ত্র করছে। তবে আমরা সব সময় নির্বাচনের পক্ষে। ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচন ছাড়া প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। এবারও আমরা প্রস্তুত।’
দলীয় সূত্র আরও জানায়, জাপা যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তবে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাথমিক তালিকা তৈরি হয়েছে। চেয়ারম্যান জি এম কাদের রংপুর-৩ (সদর) এবং মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসন থেকে প্রার্থী হবেন বলেও নিশ্চিত করেছে দলীয় নেতৃত্ব। রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনে প্রার্থীদের নাম ইতোমধ্যে চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে দলটির ভেতরে এখনো কিছুটা বিভাজনের খবরও রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ জাপা নেতা জানান, ব্যারিস্টার আনিসুল হক ও রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ এনসিপির সঙ্গে জোট করার চেষ্টা করছে এবং তারা লাঙ্গল প্রতীক দাবি করছে। এই প্রতীক নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার ও কিছু রাজনৈতিক দল চাপ সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ ওই নেতার। তবে আইনগতভাবে লাঙ্গল প্রতীক জি এম কাদেরেরই নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানান তিনি।
এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ কয়েকটি দল জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞার দাবি তুলেছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা তীব্র হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে অতীতে জোটবদ্ধ থাকা দলটি এখন স্বতন্ত্রভাবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে চাইছে। দলীয় নেতাদের ভাষায়, এবার জাতীয় পার্টি চাইছে ‘এরশাদের মূলধারা’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আজমল হোসেন লেবু জানান, ‘শনিবারের সভায় সারা দেশের নেতা-কর্মীদের ডাকা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ, জোটনীতি এবং সাংগঠনিক পুনর্গঠন—সব বিষয় নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসবে। সভা শেষে জাপা রাজধানীতে শোডাউন মিছিল করবে, যা সরকারের প্রতি শক্ত বার্তা দেবে।’
রংপুর মহানগর জাপার সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম ইয়াসির বলেন, ‘জাতীয় পার্টি এখন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। ব্যারিস্টার আনিসুল হক, রুহুল আমিন হাওলাদার এবং মজিবুল হক চুন্নু আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে দলকে দুর্বল করেছিল। কিন্তু এখন জাতীয় পার্টি সেই ফ্যাসিস্ট প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে এরশাদের মূল আদর্শে ফিরে এসেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। যদি নির্বাচন কমিশন সব দলের জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে জাতীয় পার্টি অনেক আসনে বিজয়ী হবে। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে না আসে, তাহলে তাদের ভোটের বড় অংশ জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের দিকে যাবে।’
দলীয় মহলে আলোচনা চলছে, জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে একটি তৃতীয় শক্তি হিসেবে অবস্থান নিতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে রংপুর, গাইবান্ধা, কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় দলীয় কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমাগম দলটির আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় পার্টি এবার নির্বাচনী সমীকরণে ‘কিং মেকার’ ভূমিকায় থাকতে চায়। দলটি যদি শেষ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে প্রার্থী দেয়, তাহলে উত্তরাঞ্চলসহ অন্তত ৫০টি আসনে তারা বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য ও নেতৃত্বের স্বচ্ছ বার্তা।
দলীয় পর্যবেক্ষকরা আরও বলছেন, জি এম কাদেরের ওপর এখন দলের ভেতরে ও বাইরে প্রচুর চাপ রয়েছে। একদিকে আওয়ামী লীগ চাইছে তাদের সঙ্গে পুরোনো জোট ধরে রাখতে, অন্যদিকে বিএনপি ও অন্য বিরোধী দলগুলো চায় জাপা আলাদা অবস্থান নিক, যাতে নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সবশেষে, শনিবারের সভা ও মিছিলের দিকে রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে। কারণ, এই সভার সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থান, এমনকি আসন্ন সংসদ নির্বাচনের চিত্রও বদলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সকালবেলা/এমএইচ