
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘আমাদের উপদেষ্টাদের নয়, বরং পুরো জাতিরই সেফ এক্সিটের প্রয়োজন আছে।’
শনিবার (১১ অক্টোবর) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘খসড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫’ শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, বর্তমানে সেফ এক্সিট নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, এটি জাতিগত বিষয়। তিনি বলেন, ‘আমরা উপদেষ্টারা নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের কারও কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা এমন এক অসুস্থ, ভয়াবহ, আত্ম ধ্বংসী কাঠামোতে বন্দি হয়ে গেছি, যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া এখন সময়ের দাবি।’
তিনি বলেন, ‘বিগত ১৬ বছর ধরে আমরা দেখেছি দুঃশাসন, গুম, খুন এবং দুর্নীতির রাজত্ব। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা এমন এক চক্রে পড়ে গেছে যেখানে ন্যায়বিচার ও মানবিকতার স্থান ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে। তাই ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতি হিসেবে আমাদের সেফ এক্সিট দরকার, যাতে আমরা একটি নতুন রাষ্ট্র চেতনার দিকে অগ্রসর হতে পারি।’
ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫৫ বছর ধরে আমরা দুঃশাসন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও রাজনৈতিক দমননীতির সাক্ষী। এই ভয়াবহ রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বেরিয়ে আসাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’ তিনি মনে করেন, শুধুমাত্র ভালো আইন প্রণয়ন করলেই দেশ উন্নত হয় না; তার প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণই হলো মূল বিষয়। ‘আমরা হয়ত ভালো ভালো আইন তৈরি করছি, কিন্তু ভালো আইন মানেই ভালো রাষ্ট্র নয়। আমার বয়সে এসে বুঝেছি, ভালো আইন নয়, ভালো প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিই। কিন্তু প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী না হলে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। বাহাত্তরের সংবিধানে কিছু ভালো বিধান ছিল, যেমন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে রাষ্ট্রপতি যেন স্বাধীনভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে সেটি কখনোই হয়নি। সবসময় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছে।’
আসিফ নজরুল উল্লেখ করেন, ‘এমনও অনেক বিচারপতি ছিলেন, যারা গণতন্ত্র ধ্বংসের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আরও দুঃখজনক হলো, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো সরকারের সংস্কার কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন।’ তিনি বলেন, ‘ভালো আইনের ওপর যদি খারাপ প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো হয়, তাহলে সেই আইন কোনো সুফল বয়ে আনে না। তাই আমাদের প্রথম কাজ হতে হবে প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারে এসে আমি দেখেছি, সবকিছুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আমরা চাইলে এখনো পরিবর্তন সম্ভব, যদি সবাই মিলে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নতুন পথে হাঁটি।’
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তারা সবাই মানবাধিকার কমিশনের নতুন কাঠামো, দায়বদ্ধতা এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে মতামত দেন। সাম্প্রতিক সময়ে “সেফ এক্সিট” ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন যে, ‘সরকারের অনেক উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজো তৈরি করেছেন এবং তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথা ভাবছেন।’ এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
এর জবাবে ৯ অক্টোবর ফেসবুক পোস্টে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান লিখেন, ‘বাহাত্তরোর্ধ্ব বয়সে যদি সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হয়, তাহলে তা আমার জন্য গভীর দুঃখের বিষয় হবে।’ তার আগের দিন, অর্থাৎ ৮ অক্টোবর, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা সেফ এক্সিট নিতে চান, সে প্রশ্নের উত্তর নাহিদ ইসলামকেই দিতে হবে।’
এই প্রেক্ষাপটে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, তিনি সেফ এক্সিট ইস্যুকে ব্যক্তিগত নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সংকট হিসেবে দেখছেন। তার মতে, ‘আমরা যদি সত্যিকার অর্থে একটি মানবিক, আইনের শাসননির্ভর রাষ্ট্র গঠন করতে চাই, তাহলে আমাদের প্রথমেই প্রয়োজন সঠিক নৈতিক দিকনির্দেশনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্র এখন এমন এক জটিল পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে দুর্নীতি, দলীয়করণ, আর প্রশাসনিক পক্ষপাত একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের জাতি হিসেবে পুনর্জাগরণের পথ বেছে নিতে হবে।’ তার মতে, ‘একটি জাতি হিসেবে সেফ এক্সিট মানে হলো দুর্নীতি, দমননীতি, অন্যায় ও বৈষম্যের চক্র থেকে বেরিয়ে আসা। এটি কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক নিরাপত্তা নয়, বরং একটি সম্মিলিত মুক্তির প্রয়াস।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি সাহসের সঙ্গে সত্য কথা বলতে না পারি, যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান না নেই, তাহলে কোনো সেফ এক্সিটই আমাদের রক্ষা করতে পারবে না।’ সভায় উপস্থিত অন্য বক্তারাও একমত হন যে, আইন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নৈতিক নেতৃত্ব, জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য। ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, তিনি শুধু বর্তমান সরকারের নয়, পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন।
সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘সেফ এক্সিটের আলোচনা যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়েও বেশি এটা সামাজিক। আমাদের জনগণই এখন সেফ এক্সিটের অপেক্ষায়, একটি সুষ্ঠু, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক রাষ্ট্রের দিকে।’ তার বক্তব্যে উঠে আসে গভীর হতাশা, তবে আশাবাদও। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে দুটি পথ, একটি হলো আত্মবিনাশের, অন্যটি আত্মশুদ্ধির। আমরা যদি সৎভাবে আত্মসমালোচনা করতে পারি, তাহলে এখনো আশা আছে।’
এই বক্তব্যে যেন প্রতিফলিত হয় বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। আসিফ নজরুলের মতে, ‘জাতি হিসেবে আমাদের সেফ এক্সিটের অর্থ হলো, দায়িত্বহীন রাজনীতি, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, আর ভয়ভীতির সংস্কৃতি থেকে মুক্তি।’
সকালবেলা/এমএইচ